From Fb. Orginally taked by ____ By and published in Ananda Vubon Magazine , 2006 February 1st Edition.
১৯৮৬ সালের মাঝামাঝি। সায়েন্স ল্যাবে মেলােডি মিউজিকাল স্টোরে ঢুকে দেখি এক টুপি পরা ভদ্রলােক এ্যাকুস্টিক গিটার বাজাচ্ছেন। আধা ঘণ্টা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার
বাজানাে দেখলাম। আসলে ওই বয়সে আমি সামনাসামনি এত ভালাে গিটার প্লেইং কখনাে দেখিনি। পিঙ্ক ফ্লয়েড-এর ‘দ্য ওয়াল’ গানের সলাে কেউ যে হুবহু বাজাতে পারবে তা আমার ধারণাতেই ছিলাে না। পরে ১৯৮৬ সালের অক্টোবর মাসে আমার জীবনের প্রথম শাে করার প্রস্তাব আসে টিপু (ওয়ারফেজ), সুমনের (পেন্টাগন) কাছ থেকে। আমি তখন বেইজ বাজাই। নটর ডেম কলেজের আমাদের বন্ধুরা
রকস্ট্রাটা এবং ফ্রেন্ডস (টিপু, সুমনদের ব্যান্ড) এর সদস্যরা একটা কনসার্টের আয়োজন করছিল। যখন টিপু আমাকে ওদের সাথে বাজাতে বলল, তখন আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। টিপুকে জিজ্ঞেস করলাম তােমাদের ব্যান্ডের গিটারিস্ট কি রকস্ট্রাটার মঈনুলের চাইতে ভালাে? টিপু উত্তর দিল, ‘তুমি শুধু কালকে প্র্যাকটিসে আসাে।’ যতদূর মনে পড়ে সুমনের বােনের নয়া পল্টনের বাসায় আমি ফ্রেন্ডস ব্যান্ডের প্রথম
প্র্যাকটিসে যাই। গিয়ে দেখলাম সেই টুপি পরা গিটারিস্ট। জানলাম তার নাম নিলয় দাশ।
আসলে আমি ফ্রেন্ডস ব্যান্ডের সাথে বাজানাের ব্যাপারে উৎসাহ কম পাচ্ছিলাম। কারণ ওরা কোনাে হার্ডরক বা হেভি মেটাল গান করবে না। কিন্তু নিলয় ভাইকে দেখে ওই শােতে বাজানোর ব্যাপারে আমার আগ্রহ বেড়ে গেল। সেদিন প্র্যাকটিসে নিলয় ভাই ডিপ পার্পলের ‘স্মােক অন দ্য ওয়াটার’, ঈগলসের ‘হােটেল কালিফোর্নিয়া’, অল স্টুয়ার্ট-এর ‘অন দ্য বর্ডার’সহ অনেকগুলো গান বাজালেন। আর আমাকে ‘অন দ্য বর্ডার’সহ অনেকগুলাে গান তুলতে বললেন। আমি গানগুলাে তুলে পরের দিন প্র্যাকটিসে নিলয় ভাইসহ পুরাে ব্যান্ড জ্যাম করলাম। সেই শোতে শেষ পর্যন্ত নিলয় ভাই কোনাে এক কারণে বাজাননি।
তখন আমি কলাবাগানে থাকতাম। আমাদের বাসা থেকে নিলয় ভাইয়ের বাসা ১০ মিনিটের পথ। মাঝে মাঝেই নিলয় ভাইয়ের বাসায় যেতাম তার গিটার বাজানো শুনতে। ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝিতে এইচএসসি পরীক্ষার পরে নিলয় ভাইকে বললাম, আমাকে ক্লাসিক্যাল গিটার শিখাতে। নিলয় ভাই বললেন, তার গিটার স্কুলে ভর্তি না হয়ে আমি যেন তাদের সাথে বেইজ বাজাই। তিনি বিভিন্ন প্রাইভেট শােতে বাজান, তার একজন বেইজিস্ট দরকার। তখন থেকেই তার সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা এবং রাত জাগা ছিল তার অভ্যাস।
এইচএসসির ফলাফলের পর আমি এবং আমার বন্ধুরা (ওয়ারফেজ, রকস্ট্রাটা, ইন ঢাকা, এসেস-এর মেম্বাররা) বিকেল হলেই নিলয় ভাইয়ের বাসায় গিয়ে হাজির হতাম। হয়ত গিয়ে দেখতাম তখনও তিনি ঘুমাচ্ছেন। ঘুম থেকে উঠে তাকে নিয়ে সবাই মিলে সংসদ ভবনে গিয়ে শুরু হতাে গান। সেখানে ব্যাপারটা পুরােপুরি অনুরােধের আসরের মতাে ছিল। আমাদের পছন্দের সবগুলাে গানই নিলয় ভাই গাইতেন এক এক করে। আমেরিকা, অল স্টুয়ার্ট, ব্রেড, নীল ইয়াং, ক্রসবি স্টিলস ন্যাশ, লােবাে, বার্কলি জেমস হারভেস্ট, পিঙ্ক ফ্লয়েড, ড্যান ফকারবার্গ, ঈগলস, এয়ার সাপ্লাই, জিম কাকি কোনটাই বাদ যেত না। তিনি কত গান যে গাইতেন! সংসদ ভবনে বা কোনাে বন্ধুর বাসার ছাদের সেই সংগীত জালসার দিনগুলাের মতাে আনন্দময় সময় জীবনে আর হয়তাে আসবে না।
১৯৮৮ সালে আমরা উত্তরা চলে আসি। তখনাে প্রতি সন্ধ্যাতেই নিলয় ভাইকে ঘিরে আড্ডাটা বসত । আড্ডায় ওয়ারফেজের টিপু, বাবনা, রকস্ট্রাটার ইমরান, মঈনুল, আরশাদ, মাহবুব, শোয়েব, ইন ঢাকার মাশুক, তুষার, জয়
রােজেন, গাের্কি এবং এইসেসের ফুয়াদ, সাঈদ, রবি, শমীসহ অনেক বন্ধুরা থাকত। ইমরান বনানীতে থাকতাে বলে ওকে নিয়ে রাত সাড়ে আটটা হলেই আমাদেরকে বাড়ির দিকে রওনা দিতে হতাে। আড্ডা থেকে আগে চলে আসার অনেক কিছু মিস করতাম আমরা দু’জন। প্রতিদিন তাই দূরে থাকা নিয়ে প্রচুর আক্ষেপ করতাম! সাঈদের বাসা আর হােটেল গােল্ডেন গেইট-ও নিলয় ভাইকে নিয়ে প্রচুর আড্ডা দিতাম আমরা।
নিলয় ভাই মানুষ হিসেবে অনেক আমুদে ছিলেন। তার হাস্যরসবােধ ছিল তীব্র। হঠাৎ করে এমন একটা টিপ্পনি কাটতেন যে আমাদের হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত। সংগীত এবং গিটারের ব্যাপারে তার ঝোঁক এতটাই বেশি ছিল যে তিনি এগুলাে নিয়েই ২৪ ঘণ্টা কাটাতেন। তার মিউজিক কালেকশন ছিলাে ঈর্ষণীয়। অনেক দুর্লভ গান ও ইন্সট্রুমেন্টাল অ্যালবামের কালেকশন ছিল তার। ভিনি মাের বা মামস্টিনের নতুন কোনো কিছু তার হাতে পৌঁছলে তিনি আয়ােজন করে সবাইকে ডেকে শুনাতেন। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কোনটা জ্যাজ, কোনটা ব্লু গ্রাস, কোনটা ডেলটা বুজ। মিউজিশিয়ান হিসেবে নিলয় ভাই ছিলেন আমাদের হিরাে। যেমন গিটার বাজাতেন, তেমনি সুন্দর গানের গলা। আমি এখনাে তার মতাে এ্যাকুস্টিক গিটার, ক্ল্যাসিক্যাল গিটার বাজানাে বাংলাদেশে কাউকে দেখিনি। ক্লাসিক্যাল গিটারে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ‘৮০ দশকের প্রথম দিকে তিনি কোন এক কোরিয়ান ভদ্রলােকের কাছে ক্লাসিক্যাল গিটার শিখেছিলেন। প্রয়াত হ্যাপি আখান্দের সাথে বাজাতেন জ্যাজ । হার্ডরক ও হেভি মিউজিকের প্রতি ছিলাে ভীষণ ঝোঁক। গিটারিস্ট নিলয় ভাইকে আসলে বাংলাদেশের শ্রোতারা সেভাবে দেখার সুযােগ পাননি। আমার খুব কাছে থেকে উনার গিটার বাজানাে দেখার সুযােগ হয়েছে। টেকনিক্যালি তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি ভ্যান হ্যালেনের ‘এরাপশন’ ও জো স্যাট্রিয়ানির ‘মিডনাইট’ বাজাতেন। সেই সময়ে বাংলাদেশের খুব কম গিটারিস্ট আরপেজিও বাজাতে পারতাে। অথচ ওই সময়ে নিলয় ভাই লং আরপেজিও সুইপ করতেন। বেন্ড/ভাইব্রেটের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন পরিপক্ক গিটারিস্ট। তার মত এত পারফেক্ট ডায়ার স্ট্রেইটস, সান্টানা, পিঙ্ক ফ্লয়েড বাজাতে বাংলাদেশের কোনাে গিটারিস্টকে
দেখিনি। তাকে আমি অনেক দুর্বোধ্য এবং জটিল ফ্ল্যামেনকো পিস বাজাতে দেখেছি। আসলে ৮০’র দশকে বাংলাদেশে এমন কোনো গিটারিস্ট ছিলাে না যার বাজানাে আমার বা আমাদের সাথের কারাে মনে দাগ কাটতাে। সেদিক থেকে নিলয় ভাই ছিলেন আমাদের একমাত্র এবং বিশাল অনুপ্রেরণা। নিলয় ভাইয়ের কাছে আমাদের পুরাে সার্কেল (ওয়ারফেইজ, রকস্ট্রাটা, ইন ঢাকা, এইসেস) এর সদস্য মিউজিকালি কৃতজ্ঞ থাকবো আজীবন। নিলয় ভাই আমাদের এই চার ব্যান্ডের সবাইকে অনেক সাহায্যও করতেন। ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়ারফেজের প্রথম শাে’র সময় আমার নিজস্ব কোনাে গিটার ছিলাে না। নিলয় ভাই তার বিখ্যাত টোকাই ট্রাটোকাস্টার আমাকে শাে’র ১ মাস আগে থেকে দিয়ে রেখেছিলেন। উনি আমাদেরকে নিয়ে ভােকাল হারমােনি প্র্যাকটিস করাতেন। একদিন রকস্ট্রাটার মঈনুলের বাসায় নিলয় ভাই আমাদেরকে আমেরিকা ব্যান্ডের ‘রিভারসাইড’ গানটার ৪ পার্ট ডােকাল হারমােনি করাচ্ছিলেন। আমার পার্টটা করতে পারছিলাম না। বেসুরা
হয়ে যাচ্ছিল। নিলয় ভাই বাসা থেকে প্র্যাকটিস করে আসতে বললেন। কিন্তু আমি ফাঁকি দিলাম। পরদিন আবার মঈনুলের বাসায় যখন আমি বেসুরা হারমােনি করতে লাগলাম তখন নিলয় ভাই বললেন, কমল, তুমি বাদে সবাই সুরে বাজাচ্ছে, বোধহয় বাসায় প্র্যাকটিস কর নাই। এখন তােমাকে বাদ দিয়েই আমরা প্র্যাকটিস করবো। ঠিক তাই হলো। আমাকে বাদ দিয়েই প্র্যাকটিস করা শুরু হলাে। আমি মনে মনে প্রচণ্ড ওফেনডেড হলাম এবং পরদিন বাসা থেকে প্র্যাকটিস করে আসার পর আগের চেয়ে ভালাে করলাম।
যদিও নিলয় ভাই আমাকে হাতে ধরে গিটারের কোনাে কিছু শেখাননি তবুও উনিই আমার মিউজিকের গুরু, এতে কোনাে সন্দেহ নেই। উনার বাজানাে দেখেই বুঝেছি কোনটা পিভড, কোনটা সুইপ আর কোনটা ডাইমেনশন আরপেজিও। অসাধারণ রিদম গিটারিস্ট ছিলেন তিনি। আমি তার বাজানাে অনেক রিদমের তালই ধরতে পারতাম না। মিউজিক খুব ভালাে বুঝতেন এবং বােঝাতে পারতেন। মিউজিকের ব্যাকরণ খুব ভালাে জানা ছিল তার। স্টাফ নােটেশন পড়তে পারতেন দক্ষভাবে। খুব নামকরা অনেক ক্লাসিক্যাল গিটার পিস উনি অনায়াসে বাজাতেন। কানে শুনে নিলয় ভাই যেকোনাে গানের গিটার অংশ হুবহু তুলতে পারতেন, সেটা যতই কঠিনই হােক না কেন। ওই যুগে গানের ট্যাবও ছিলাে না। নিলয় ভাইয়ের হেয়ারিং সেন্স ছিলাে গড গিফটেড। ১৯৮৯ সালে উনার প্রথম একক অ্যালবাম সারগাম থেকে বের হয়। আমি অ্যালবামের একটি গানে বেইজ বাজাই। বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিক সোসাইটি থেকে বের হওয়া রুচিসম্মত অ্যালবাম এটি। ‘বিরহ বরষা’, ‘সেই যে চলে গেলে’ গানগুলাে আমার এখনও পর্যন্ত অনেক প্রিয়।
১৯৯০ থেকে আমি ব্যস্ত হয়ে যাই এবং ১৯৯১-এ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় নিলয় ভাইয়ের সাথে দেখাশােনা কমে যায়। ১৯৮৯ সালে আমার বাসায় একবার হঠাৎ করে উনার
বুকে ব্যথা শুরু হয়। আমরা তখন উনাকে সচেতন হতে বলি। কিন্তু নিলয় ভাই কখনাে নিজের যত্ন নিতেন না। রিচ ফুডের বিষয়ে উনার লােভ ছিল।
১২ জানুয়ারি এক বন্ধু সকালে জানালাে নিলয় ভাই আর নেই। সাথে সাথে রওয়ানা দিলাম পােস্তগােলা শ্মশান ঘাটে। পৌঁছে দেখি নিলয় ভাইয়ের দাহ শুরু হয়ে গেছে। এখনও প্রচণ্ড খারাপ লাগছে উনাকে শেষবার দেখতে পেলাম না। শুনেছি চট্টগ্রামে ঈদের দিন বিকেলে বুকে ব্যথা অনুভব করেন, তারপর হসপিটালে রাতে মারা যান। আমার দেখা দেশের প্রথম গিটার হিরাে তিনি। সেদিন মনে হচ্ছিল নলয় ভাইয়ের সাথে আরাে বেশি সময় কাটাতে পারলে ভালাে হতো। গত ১৫ বছরে হাতে গােনা কয়েকবার নিলয় ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে। প্রতিবারই তার উপর রাগ করেছি। কারণ উনি কিছুই করছিলেন না মিউজিক্যালি । নিলয় ভাই সব সময় আমাকে বলতেন কমল তুমি অনেক ভালাে করবে মিউজিকে। নিলয় ভাই আপনি যেখানেই থাকেন না কেন আপনাকে ধন্যবাদ আমাকে উৎসাহ দেবার জন্য, মিউজিকালি আমার উপর আস্থা রাখার জন্য । আপনি সত্যিকার অর্থে আমার সংগীতে প্রেরণা, আমাদের সত্যিকারের গিটার হিরাে। খারাপ লাগে যে আমাদের জন্য প্রচুর মিউজিক রেখে যাননি। বাংলাদেশ জানতে পারল না যে আপনি কত বড় মিউজিশিয়ান ছিলেন। আপনাকে ধন্যবাদ সব সুন্দর স্মৃতির জন্য ।
আরেকটি স্মৃতিকথা দিয়ে শেষ করি। ১৯৮৭ সালে হ্যাপি আখান্দ যেদিন মারা গেলেন সেইদিন রাতে নিলয় ভাইয়ের সাথে দেখা। নিলয় ভাই খুব ভেঙে পড়েছিলেন। তিনি বারবার বলছিলেন হ্যাপি আখান্দ কত বড় মিউজিশিয়ান ছিলেন। আরও বলছিলেন হ্যাপি আমাদের জন্য কিছুই রেখে গেলেন না। নির্মম সত্য যে, নিলয় ভাইও আমাদের জন্য কয়েকটি অ্যালবাম ছাড়া কিছুই রেখে গেলেন না। নিলয় ভাইয়ের মতাে সংগীত প্রতিভার চিরবিদায় আমাদের দেশের সংগীতের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
লেখক : গিটারিস্ট (ওয়ারফেজ)
বি. দ্র. ২০০৬ সালের ১১ জানুয়ারি নিলয় দাশের মৃত্যুর পর আমার এক অনুরোধে ‘আনন্দভুবন’ ম্যাগাজিনে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি লেখেন ওয়ারফেজের গিটারিস্ট ইব্রাহিম আহমেদ কমল। একই বছর ১ ফেব্রুয়ারি লেখাটি প্রকাশ হয়।
Ibrahim Ahmed Kamal, Niloy Das, Mainul, Mahabub

Ibrahim Ahmed Kamal, Niloy Das, Mainul, Mahabub

ছবি: ১৯৮৮ সালে রকস্রাটার গিটারিস্ট মাঈনুলের বাসায় নিলয় দাশ, ওয়ারফেজের কমল, রকস্ট্রাটার মাঈনুল ও মাহাবুব