আমার দেখা নিলয় দাস। প্রয়াতঃ নিলয় দাস (1962-2006) আমার দেখা বাংলাদেশের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ মিউজিশিয়ান গিটারিস্ট। আজকে আমি নিলয় ভাই এর একটু গল্প করতে চাই। নিলয় ভাই কে ছিলেন আমার, আমার সংগীত জীবনে উনার অবদান কতোটুকু এ প্রশ্ন অনেকেই জিজ্ঞেস করেন। নিলয় ভাই অবশ্যই আমার সংগীতের সর্বশ্রেষ্ঠ গুরু। আমি বেস গিটার শেখার জন্য শিকদার ইফতেখার ভাইয়ের কাছে তিনটি ক্লাস করেছি। এছাড়া Rockstrata’r ইমরান এবং মইনুল, In Dhaka’r মাসুক এবং জয় Aces er সাঈদ এবং ফুয়াদ, Warfaze er রাসেল, Aurthohin er পিকলু আমাকে গিটার শিক্ষা তে সাহায্য করেছে। কিন্তু প্রকৃত ভাবে কেউ যদি গুরু ছিলেন সেটা অবশ্যই নিলয় ভাই । 1986 প্রথমদিকে এলিফ্যান্ট রোডে মেলোডি মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্ট সপে উনাকে প্রথম বারের মতো গিটার বাজাতে দেখি। মাস ছয়েক পরে টিপুর মাধ্যমে নিলয় ভাই এর সাথে আবার সঠিকভাবে পরিচয় হয়। 1986 সালে আমি আমার জীবন প্রথম কনসার্টে বাজানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ওই ব্যান্ডে টিপু, পেন্টাগনের সুমন, শওকত আলী ইমন এবং আমি ছাড়া গিটারিস্ট হিসেবে নিলয় দাসের বাজানোর কথা ছিল। টিপু এবং সুমনের বোনের বাসায় নিলয় ভাই কে প্রথম সামনাসামনি সময় ধরে গিটার বাজাতে দেখি। তারপরে তার গিটার playing মিউজিশিয়ানশিপ কোন কিছু নিয়ে আমাদের কোনো ধরনেরই দ্বিধা ছিল না। নিলয় ভাই ছিলেন একজন টোটাল প্যাকেজ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে উনি ওই কনসার্টে বাজাতে পারেন নি, কিন্তু আমার জীবনের প্রথম স্টেজ পারফরম্যান্স হয়ে গেল। 1987 শেষের দিকে তার কাছে ক্লাস করার জন্য তার বাসায় যাই। ওয়ারফেজ রকস্ট্রাটা ইন ঢাকা Aces ব্যান্ডের সবাই প্রতিদিন বিকেল থেকে সংসদ ভবন বা কারো বাসার ছাদের নিলয় ভাইকে নিয়ে তার বিশাল সঙ্গীতসন্ধ্যায় অভিভূত হয়ে তার সাথে সময় কাটাতাম। শুধু গিটারের হাত না গানের গলা তো ছিল বিশ্বমানের। আমাদের পছন্দের ছোটবেলার বিটলস, পিঙ্ক ফ্লয়েড, সাইমন এন্ড Gurfunkle, CSNY, Bread, America, Air Supply.. সবকিছুই করতে পারতেন। উনার গিটারের skill বোঝবার ক্ষমতা ওই সময় আমাদের ছিল না। উনি আমাদেরকে একটি গান বা একটি গিটারের piece বাজিয়ে বুঝাতেন কেন এটা ক্লাসিক্যাল,এটা ব্লুজ,এটা কান্ট্রি এটা jazz। নিলয় ভাই ঘন্টার পর ঘন্টা ইম্প্রভাইজ করতেন, বাজাতে থাকতেন।এরমধ্যে যা মনে রাখতে পারতাম সেগুলো বাসায় এসে অবশ্যই প্র্যাকটিস করতাম, কারণ নিলয় ভাই 1988 সালে যা বাযাচ্ছিলেন, উনার সংগীত বাজানোর মতো হাত আমাদের কারোরই ডেভেলপ করে নাই। আমি বেস গিটার বাজাতাম গীটার বাজানো এর পাশাপাশি। নিলয় ভাই আমাকে একবার বললেন ” কমল তুমি এই jazz পিসটার সাথে একটু bass বাজাও”। আমি এটা শুনে ভয়ে শেষ। নিলয় ভাই এবং বাকি বন্ধুরা সাহস দিল। এরপরে নিলয় ভাই কোন নতুন গান বা টেকনিক তুললে উনি আমাকে ওটার সাথে bass বাজাতে বলতেন। মাঝে মাঝে প্রচন্ড সুন্দর বেসলাইন উনি তৈরি করে দিতেন, আমি মুখস্থ করে নিয়ে বাজাতাম। আসলে পুরো সময়টা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি কারণ আমরা তখন আমাদের ঢাকা ইউনিভার্সিটির জীবন শুরু করলাম। দিন শুরু হতো উত্তরা থেকে ঢাকা ইউনিভার্সিটি যাওয়া দিয়ে। প্রতি বিকালে নিলয় ভাইয়ের সুন্দর সঙ্গীতসন্ধ্যা। কিন্তু রাত আটটার সময় আমাদের বাড়ি ফিরতে হত। 1989 এ জীবন আরো কঠিনতর হয়ে গেল। নিলয় ভাই উনার solo অ্যালবাম রেকর্ডিং করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি একটা গানে bass বাজানোর সুযোগ পেলাম। জীবনের চাপ বারবার সাথে সাথে উনার সাথে আর আগের মত সময় দিতে পারলাম না। 1991 এ পড়াশোনা করার জন্য আমেরিকা চলে আসলাম আমি, মইনুল, ইমরান, মাসুক, জয়, তুষার, রোমেল, রাসেল, বাবনা পিকলু। 90 দশকে নিলয় ভাই এর ক্যারিয়ার খুব একটা আগালো না। কারণটা কি ছিল? উনার সাথে বাজানোর মতো ক্ষমতা রাখেন এইসব মিউজিশিয়ানরা তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। অভিমানী নিলয় ভাই একা একা থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন 2006 সালের 11 ই জানুয়ারি তে। উনি মারা যাওয়ার খবর পাওয়া মাত্রই আমি এবং টিপু পোস্তগোলা শ্মশান এ উনার শেষকৃত্যে যাই । তারপরে তো শুধু নিলয় ভাই এর জন্য দোয়া করা ছাড়া কিছুই করতে পারলাম না। আর মুখ দেখাতে পারলাম না ভাইয়ের পরিবারের কাছে। এখনো পারি নাই। নিলয় ভাই এর বোন মিতা আপাকে ফোন করে কয়েক মাস আগে ক্ষমা চেয়েছি। 2008 সালে শেরাটনে নিলয় দাসের বাবা প্রয়াত সুধীন দাশ এর সাথে শেষ দেখা। কাকার কাছে আমি ক্ষমা চেয়েছি যে আমি নিলয় ভাইয়ের জন্য কিছু করতে পারি নাই। নিলয় দাস এমন একজন মিউজিক্যাল নক্ষত্র যে লক্ষ বছরে হয়তো পৃথিবীতে একবার আসে। তার মত গিটারের দক্ষ হাত যখন বছরের পর বছর আমাদের অবহেলা, সমাজের অবহেলার কারণে বিলীন হয়ে যায়, তখন আক্ষেপ করে তাকে আর ফেরানো যাবে না। আমি আমার গুরুর জন্য কিছু করতে পারিনি এটা আমার ব্যর্থতা এটা আমার লজ্জা। উপরে ভালো থাকেন নিলয় ভাই । আল্লাহতায়ালা আপনাকে বেহেস্ত নসিব করুন, আমিন।